বিড়াল পোষা আনন্দের কিন্তু দায়িত্বপূর্ণ। তাদের স্বাস্থ্যের যত্ন, সঠিক খাদ্যতালিকা, পরিচ্ছন্নতা, শারীরিক ও মানসিক ভালো রাখতে আপনাকে সচেষ্ট হতে হবে। বিড়াল পোষার শখ নতুন কিছু নয়, প্রাচীনকাল থেকে মানুষজন বাড়িতে এই প্রাণীটি পালেন। আপনি যদি বাড়িতে বিড়াল পালন করতে চান, তবে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য।
এখানে আমি বিড়াল কেনার আগে ও পলার সময় যে সকল বিষয় (যত্ন, খাবার, চিকিৎসা, ইত্যাদি) জানা জরুরী সেগুলো তুলে ধরেছি।
বিড়াল মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে। আর, সে খুব সহজেই পোষ মেনে যায়। তবে হুট করে একে বাড়িতে নিয়ে আসলেই হবে না। তার আগে প্রয়োজন বেশ কিছু প্রস্তুতির। সবার আগে জেনে নিন আপনার পরিবারের সদস্যরা এই বিষয়টি কীভাবে দেখবেন। কেননা সবাই এই আদুরে কিন্তু দুষ্টু প্রকৃতির প্রানীটিকে ভালো নাও বাসতে পারে।
পরিবারের সদস্যেদের মতামত জেনে নেয়র পর বিড়াল পালনের নিয়ম সম্পর্কে জেনে নিন সাথে একে পোষ মানানোর উপায়গুলোও জেনে নিতে হবে। এছাড়াও প্রানীটিকে বাড়িতে আনার আগে আরও কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন আর এগুলো হলোঃ
আপনি যদি মুসলিম হয়ে থাকেন তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে বিড়াল লালন-পালন সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। বিড়াল সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস ইসলামে রয়েছে যা থেকে জানা যায় যে বিড়াল পালন বৈধ তবে তার সঠিক যত্ন নেয়া জরুরী। অর্থাৎ তাদের কষ্ট দেয়া যাবে না।
এছাড়াও আরো একটি ভিন্ন হাদিসে পশু-পাখি ও আল্লাহর যে কোন সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখানোর কথা বলা হয়েছে কেননা এতে মহান রবের নিকট থেকেও দয়া লাভ করা যায়। সুতরাং ইসলামে বিড়াল পোষা জায়েজ।
বিড়াল পালনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল একাকীত্ব দূর করা। বিড়াল আপনার বন্ধুসুলভ আচরণ খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে তাই সে তা ফেরতও দিতে পারে। বিড়ালের যত্ন নিতে নিতে আপনি অন্যদের প্রতিও যত্নশীল হয়ে উঠবেন। যেহেতু বিড়াল কম খাবার খায় তাই কম খরচে একটি ভালো সঙ্গী পাবেন।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বিড়াল পালন করলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে যার প্রভাব শারীরিকভাবেও দেখা যায়। এছাড়াও একটি ছোট্ট গলু-মলু আদুরে বিড়াল আপনাকে স্মার্টও করে তুলবে।
বিড়াল পালনের তেমন কোন অপকারিতা নেই। তবে একে বাইরের পশুর সাথে মিশতে দেয়া উচিত নয় কারন এতে রোগ-জীবাণু ছড়াতে পারে।
বিড়ালকে যদি টিকা দেয়া না হয় তাহলে তার আঁচড় ও কামড়ে জলাতঙ্ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও পোষা বিড়াল সাধারনত আক্রমনাত্বক হয় না। এছাড়াও প্রায় সব ধরনের বিড়ালের লালা ও মলমূত্রে টকশোপ্লাজমসিস নামক জীবাণু থাকে যা মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে।
বাসায় প্রথমবারের মত বিড়াল আনতে চাইলে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। যেমন
আপনার হালকা বা ঘন কেমন পশমের বিড়াল পছন্দ
বাসায় শিশু থাকলে তার জন্য উপযুক্ত হবে এমন বিড়াল বাছাই
বাসায় ইতোমধ্যে অন্য কোন পোষ্য প্রানী থাকলে তার সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করতে হবে
বিড়ালের বয়স কেমন হবে সেটাও বিবেচনা করতে হবে, ইত্যাদি।
এসব তো গেল বিড়াল বাসায় আনার আগে বিবেচ্য বিষয়। এখন সঠিক বিড়ালের জাত নির্বাচন করবেন কীভাবে? চলুন তাহলে শহরের ফ্ল্যাট বাসাগুলোতে ভালোভাবে থাকতে পারবে এমন কিছু বিশেষ জাতের বিড়ালের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক-
ব্রিটিশ শর্ট হেয়ারঃ এই বিড়ালগুলো সাধারণত ফ্ল্যাট, এপার্টমেন্টগুলোতে ভালো থাকতে পারে এমনকি দীর্ঘসময় মালিকের অনুপস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে।
রাশিয়ান ব্লুঃ এই বিড়ালগুলো বেশ নরম স্বভাবের হয়। এরা গাছে চড়তে ভালোবাসে। তাই এই বিড়ালকে পোষ মানানোর উপায় হল বাড়িতে গাছ রাখা।
রাগডলঃ আপনার যদি বড় জাতের বিড়াল পছন্দ হয় তাহলে রাগডল নির্বাচন করতে পারেন। কারনে এগুলো আকারে বেশ বড় তবে স্বভাবে শান্ত।
বার্মিজ ক্যাটঃ আপনার বাড়ির পরিবেশ যদি শান্ত হয় তাহলে বার্মিজ ক্যাট পালতে পারেন। এরা মালিকের সংগ পেতে বেশ পছন্দ করে।
দেশি বিড়ালঃ আমাদের দেশীয় বিড়ালও কিন্তু বিদেশীগুলোর চেয়ে সৌন্দর্যে কোন অংশে কম নয়। তাই আপনার পছন্দে দেশি বিড়ালও রাখতে পারেন।
বিড়ালের জাত নির্বাচন তো হল। এবার প্রশ্ন হল পোষা বিড়ালের কতটুকু যত্ন প্রয়োজন। প্রথমেই বিড়াল পালনের নিয়মগুলো জেনে নিন। তাকে সময় দিন, খেলনা দিন সাথে আপনিও খেলুন। সম্ভব হলে বেয়ে উঠতে পারবে এমন ব্যবস্থা করে দিন। সময় সুযোগ করে বাইরে হাটতে নিয়ে যান।
আপনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে যেতে হলে পর্যাপ্ত পরিমানে খাবার ও পানির ব্যবস্থা করে রেখে যেতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই ছোট্ট তুলতুলে প্রানীটির টিকার ব্যবস্থা করাও জরুরী। জলাতঙ্ক সহ প্রয়োজনীয় সকল টিকার নির্ধারিত বয়সসীমা রয়েছে। সেই বয়স সীমার মধ্যেই টিকার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা টিকা বিড়ালকেও নিরাপদ রাখবে সাথে তার আঁচড় কামড় থেকে আপনাকে নিরাপদ রাখবে।
আপনার বাসাকে বিড়ালের জন্য নিরাপদ রাখুন। বহুতল ভবন হলে সে যেন লাফিয়ে নিচে না পড়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। ইঁদুর বা তেলাপোকা মারার বিষ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। বিড়ালকে মাসে অন্তত ২বার গোসল করাতে হবে। তাকে নিয়মিত ক্রিমির ঔষধ এবং প্রতিবছর ভ্যাকসিন দিতে ভুলবেন না।
আপনি যদি শহরে কোন ফ্ল্যাট বা এপার্টমেন্ট বাসায় বাস করেন তাহলে বিড়ালকে বাড়ির ভেতরেই রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এর কিছু সুবিধা হল প্রানীটি নিরাপদ থাকবে, পালানোর বা চুরি হওয়ার ভয় থাকবে না, বাইরের প্রানীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকবে না এবং আপনি সবসময় জানতে পারবেন যে আপনার পোষ্য কোথায় আছে।
তবে ঘরে বিড়াল পালার কিছু অসুবিধাও রয়েছে যেমন ব্যায়ামের সুযোগ কমে যায়, তাদের মানসিক উদ্দীপনার প্রয়োজন হয়।
আপনার বাসা যদি যথেষ্ট খোলামেলা হয় এবং বাড়ির বাইরে বিড়াল রাখার পর্যাপ্ত যায়গা থাকে তাহলে সেখানেও রাখতে পারেন। বিড়াল বাইরে রাখার কিছু সুবিধা হল প্রাকৃতিকভাবেই ব্যায়াম হয়ে যায়, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, অযাচিত আচরণ করা থেকে বিরত থাকে, বাড়ির ভেতর নোংরা হয় না।
এর বিপরীতে কিছু সমস্যা রয়েছে যেমন পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে এবং চুরি বা দূর্ঘটনা হতে পারে।
ভিন্ন ভিন্ন জাতের বিড়াল ভিন্ন ভিন্ন খাবার খেতে পছন্দ করে। তাই বিড়ালের খাবার নির্বাচন করার আগে এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
বিড়ালের জন্য ঘরে তৈরি করা খাবারই সবচেয়ে ভালো। অন্য মশলা বাদ দিয়ে শুধু লবন দিয়ে মাছ বা মাংস সিদ্ধ করে তা ভাতের সাথে চটকিয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত হবে।
বিড়াল খাবার না খেলে জোর করা যাবে না। বরং খাবারে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এখন বাজারে অনেক রেডি ক্যাট ফুড পাওয়া যায়। এই খাবারগুলোর দাম কিছুটা বেশি হলেও স্বাদে ও পুষ্টিতে বেশ ভালো।
অধিক ব্যায় এড়াতে বিড়ালের খাবারের তালিকা তৈরি করে রাখুন। এবার এই তালিকা অনুযায়ী মাঝে মাঝে ঘরে তৈরি খাবার আবার মাঝে মাঝে বাজারের রেডি ক্যাট ফুড দিন। এভাবে আপনার পোষ্যর পুষ্টিও বজায় থাকবে এবং আপনার ব্যায়ও সীমিত হবে।
বিড়াল পালন একদিকে যেমন আনন্দদায়ক অন্য দিকে বেশ দায়িত্বেরও। নরম, তুলতুলে ছোট্ট পোষ্যটিকে স্বাস্থ্যবান রাখতে আপনাকে বেশ কিছু সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনঃ
বাজারে নানা আকার ও ধরনের লিটার বক্স কিনতে পাওয়া যায়। আপনার পোষ্যর আকৃতি অনুযায়ী আপনি লিটার বক্স পছন্দ করতে পারেন।
টিকাঃ টিকা হল এক ধরনের প্রতিষেধক যা মানবদেহের মতই বিড়ালের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিড়ালের কিছু মারাত্বক রোগ আছে যা মানুষের শরীরে সক্রমিত হতে পারে কিন্তু টিকা দিলে মানুষ এবং বিড়াল উভয়েই নিরাপদ থাকে তাই টিকা দেয়া অনেক জরুরী।
বিড়ালের অনেক ধরনের টিকা থাকলেও বাংলাদেশে মূলত ৩টি টিকা দেয়া হয়, এগুলো হল
Nobivac vaccine
Rabisin vaccine
Quadricat vaccine
যে কোন ভেটেনারি সেন্টার থেকে এই টিকাগুলো দেয়া যাবে।
সাপ্লিমেন্টঃ বিড়াল কত বছর বাঁচে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় তবে গড়ে ১৪-১৬ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। আপনার প্রিয় পোষ্যটির আয়ু যতটুকুই হোক, তার সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করে তাকে সুস্থ রাখা আপনার কর্তব্য।
তাই বিড়ালের পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনবোধে সাপ্লিমেন্ট দেয়া যেতে পারে। যেমন দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে, হাড় ও ত্বক ভালো রাখতে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেয়া যেতে পারে।
হাড় ও দাঁতের সুরক্ষার জন্য মিনারেল সাপ্লিমেন্ট দিতে পারেন।
হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করার জন্য দিতে পারেন প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট। তবে যে কোন সাপ্লিমেন্ট দেয়ার আগে অবশ্যই একজন পশু চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
বিড়াল পালন করতে কত টাকা খরচ হতে পারে তা বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমনঃ
আপনি কী ধরনের খাবার দিচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে মাসে আনুমানিক ১০০০ থেকে ৩০০০ টাকা খরচ হতে পারে।
টিকা, গ্রুমিং ইত্যাদির জন্য বাৎসরিক প্রায় ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা লাগতে পারে।
বিড়ালের থাকার জায়গা তৈরি, বিছানা, এবং খেলনা বাবদ এককালীন ৫০০০ টাকার মত খরচ হতে পারে।
লিটার বক্সের অনেক ধরন রয়েছে তবে প্রতি মাসে লিটার বক্স ও লিটার এর জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রয়োজন হতে পারে।
এই সব খরচ বাদে আপনার বাজেটে আরো কিছু টাকা বরাদ্দ রাখা উচিত অপ্রত্যাশিত খরচের জন্য।
আপনার প্রিয় বিড়ালের যত্নে আরোগ্য আছে আপনার পাশে
বিড়াল সংবেদনশীল প্রানী। তাই এর জন্য প্রয়োজনীয় রেডি ফুড, গ্রুমিং এর জিনিসপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামের কোয়ালিটি ভালো হওয়া অনেক জরুরী। তবে ভালো ব্র্যান্ড ও কোয়ালিটির ভিত্তিতে খরচ বেড়ে যেতে পারে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই! কারন আপনার প্রিয় বিড়ালের যত্নে আরোগ্য আছে আপনার পাশে।
বিড়াল পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সকল জিনিসই আরোগ্যতে সেরা দামে ও মানে এখন পাওয়া যাচ্ছে।
FAQ
বিড়ালকে পোষ মানানোর উপায় কি?
উত্তরঃ সহজভাবে বিড়াল পোষ মানানোর উপায় হল তাকে সময় দেয়া, তার সাথে খেলা। সম্ভব হলে নিয়মিত বিড়ালকে বাইরে কিছু সময়ের জন্য বের করা উচিত।
নতুনদের জন্য বিদেশী না দেশি বিড়াল ভালো?
উত্তরঃ আপনি যদি বিড়াল পালনে একেবারে নতুন হন তাহলে দেশি জাতের বিড়াল ভালো হবে। কারন দেশি বিড়ালের তুলনামূলক কম যত্নের প্রয়োজন হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকে।
বিড়ালের যত্ন করতে প্রতিদিন কতটুকু সময় লাগে?
উত্তরঃ বিড়াল পরিচ্ছন্ন প্রানী। তাই লিটার বক্স পরিস্কার সহ প্রতিদিনের যত্নে কম পক্ষে ৫ থেকে ১০ মিনিট লাগতে পারে।
কতক্ষণ পোষা বিড়ালকে একা রাখা যাবে?
উত্তরঃ প্রতিটা বিড়ালের চাহিদা ভিন্ন। এছাড়া মালিকের সাথে সম্পর্ক ও বাড়িতে অন্য প্রানীর উপস্থিতির ভিত্তিতে ৪ ঘন্টা একা রাখা যেতে পারে।
বিড়াল থেকে কি কি রোগ জীবানু ছড়ায়?
উত্তরঃ সুস্থ ও অসুস্থ সব ধরনের বিড়ালের লালা ও মলমূত্রে টকশোপ্লাজমসিস নামে এক ধরনের জীবাণু পাওয়া যায় যা গর্ভবতী নারীদের জন্য ক্ষতিকর। এই জীবাণু বিড়ালের শরীরেও লেগে থাকতে পারে যা খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে।
Was this post helpful?0
0